Wellcome to National Portal
মেনু নির্বাচন করুন
Main Comtent Skiped

Image
Title
The traditional Gourangbari temple of Hindu religion
Details

অহিংসার মহান সাধক ছিলেন শ্রী শ্রী নরোত্তম দাস ঠাকুর। সনাতন হিন্দু বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার করতে গিয়ে সমাজে সম অধিকার প্রতিষ্ঠা ও মানব সেবার কাজ করতেন। নরোত্তম ঠাকুরের জন্ম ১৫৩১ খ্রিস্টাব্দে রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী উপজেলার প্রেমতলী পদ্মাতীরস্থ গোপালপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৬১১ খ্রিস্টাব্দে প্রেমতলী খেতুরধামে মৃত্যুবরণ করেন। তার পিতা জমিদার কৃষ্ণনন্দ দাস মজুমদার ও মাতা নারায়নী রানী। নরোত্তম ঠাকুর ধনী পিতার একমাত্র সমত্মান হওয়া সত্ত্বেও ধনৈশ্বর্যলিপ্সা তার জীবনে কিছুমাত্র প্রভাব ফেলতে পারেনি। তিনি বাল্যকাল থেকে ধর্মপরায়ণ, সংসার বৈরাগী ও উদাসীন প্রকৃতির লোক ছিলেন। বৃহত্তর হিন্দু সমাজে চৈতন্যদেবের প্রভাব বিচার করলে তার দান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকার করতে হয়। ঠাকুর নরোত্তম দাসের বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার, সমাজ সংস্কার ও মানব সেবার কাছে হার মেনে সমাজের ধনী, ভূস্বামী, দুর্দামত্ম নরঘাতক, ডাকাত, বিদ্যা মদোদ্ধত ব্রাহ্মণ-সকলেই তার পদপ্রামেত্ম লুটিয়ে পড়েছিলেন। অথচ এ চিরকর্মের চরিত্রে স্ফটিকশুভ্র চরিত্রে বিন্দুমাত্র মলিনতার ছাপ পড়েনি। নরোত্তম ঠাকুরকে স্মরণ করতে গোদাগাড়ীর ঐতিহ্যমন্ডিত গৌরাঙ্গবাড়িতে প্রতিবছর পালিত হয় তীরভাব তিথি। এ অনুষ্ঠানে লাখ লাখ নরোত্তম ভক্তের সমাগম ঘটে। ইতিহাসে পাওয়া যায় লালন শাহ্ও নরোত্তম দাসের তীরোভাব তিথিতে যোগ দিয়েছিলেন। নরোত্তম দাসের অনুসারী ছিলেন, মহাত্মা গান্ধী। কিন্তু তিনি কখনো গৌরাঙ্গবাড়িতে আসেনি। বৈষ্ণব ধর্মই পালন করে গেছেন মহাত্মা গান্ধী। আগামী ১৬, ১৭ ও ১৮ অক্টোবর নরোত্তম দাসের তীরোভাব তিথি পালিত হবে। ভক্তরা এসে দিনরাত কীর্তন, প্রার্থনা, প্রসাদগ্রহণ ও পূজা করার মধ্য দিয়ে তিনদিন অতিবাহিত করবে। আলোচনা চলবে বৈষ্ণব ধর্ম সম্পর্কে। নরোত্তম নিজ গ্রাম গোপালপুরের সন্নিকটে খেতুরীতে আশ্রম নির্মাণ করে ধর্মসাধনায় ব্যবপৃত হলেন। এখানে তিনি প্রায় সাধারণ বেশে অবস্থায় করতে লাগলেন। পিতৃ অনুরোধ উপক্ষো করে, বিলাস পরিত্যাগ করে তিনি স্থানীয় কৃষ্ণমন্দিরে প্রায় সন্ন্যাসীর জীবন যাপন করতে লাগলেন।এই অবস্থায় একদিন বিষ্ণুপুর থেকে প্রাপ্ত শ্রীনিবাসের পত্রে তিনি জানতে পারলেন যে হৃত গ্রন্থসমূহ উদ্ধার করা হয়েছে। তিনি হৃতয় মনে স্বর্গীয় আনন্দ অনুভব করলেন। নতুন উৎসাহ উদ্দীপনায় ধর্ম সাধনায় গভীরভাবে নিমজ্জিত হলেন। এখন থেকেই জীবন সাধনার নবতর পর্যায় শুরু হল। তিনি গৃহে ঘুরে ফিরে ধর্ম প্রচার করতেন না। বরং খেতুরীর আশ্রমে বসেই তিনি অবাক হয়ে দেখলেন ক্রমেই তিনি এক রসিক প্রেমভিক্ষু ভক্তমন্ডলীর দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়েছেন। সে-যাই হোক, ধর্ম সাধনার এই পর্যায়ে তিনি কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কার্য সমাধা করলেন, যার প্রভাবে গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজের মধ্যে তাঁর খ্যাতি ও সাধনার দুশ্চর ফল পরিব্যাপ্ত হয়ে পড়ল।  নরোত্তমের দ্বিতীয় প্রধান অবদান বৈষ্ণব সমাজ পদাবলী কীর্তন বা লীলা রসকীর্তনের প্রবর্তনা। বাংলার সঙ্গীত জগতের বিবর্তনের ইতিহাসে পদাবলী কীর্তন প্রায় চারশত বৎসর ধরে জনপ্রিয় হয়ে রয়েছে এবং শুরু বৈষ্ণব সম্প্রদায়েই নয় বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের সর্বত্রই জাতি নির্বিশেষে এর আবেদন সমান বহমান। আর সেজন্যই এই রসকীর্তন ধারার প্রবর্তক নরোত্তম দাস বিপুল যশের অধিকারী হয়েছেন। তিনি নিজেও সৃকন্ঠ গায়ক ছিলেন, একথা পূর্বেই বলা হয়েছে। পরবর্তীকালে তার প্রদর্শিন পন্থানুসরণ করে আরো কয়েকটি পদকীর্তন ঘরানার সৃষ্টি হয়েছিল। সেগুলিণ হচ্ছে ‘রেনেটি’ (রাণীহাটি), ‘মনোহরশাহী’ মান্দারনী’ এবং ঝাড়খন্ডী’। নরোত্তমের স্বীয় সঙ্গীতরীতিটি ‘গড়ানহাটি’ নামে পরিচিতি লাভ করে। অন্যান্য পদ্ধতিগুলির স্রষ্টা শ্রীনিবাস আচার্য-মনোহরশাহী। এর কীর্তনীয়া ছিলান বিখ্যাত বৈষ্ণব পদকর্তা জ্ঞানদাস, বলরাম দাস প্রমুখ। রাণীহাটি রীতির উদ্ভাবক বিপ্রদাস ঘোষ। কীর্তনিয়াগণ ছিলাম গোকুলানন্দ সেন, উদ্ধব দাস। এঁরাও বৈষ্ণব পদকার ছিলেন। অজ্ঞাত পরিচয় মান্দারনবাসী কীর্তনিয়া কর্তৃক প্রবর্তিত হয় ‘মান্দারনী’ রীতির পদকীর্তন। ‘ঝাড়খন্ডী’ রীতির প্রচলনকারীর নামও জানা যায় নি। সম্ভবত, তিনি মেদিনীপুর জেলার ঝাড়খন্ড নিবাসী ছিলেন। সে যা-ই হোক, নরোত্তমের ‘গড়ান হাটি’ রীতিউ সর্বাধিক জনপ্রিয় হয়েছিল। নরোত্তম প্রেমধর্মের আদর্শে যে সমাজ সংস্কারব্রত গ্রহণ করেছিলাম তার যথার্থ প্রভাব পড়েছিল গৌড়দ্বারে। রাজমহলের নিকটবর্তী এই গৌড়দ্বারের প্রবল প্রতাপান্বিত রাজার দুইপত্র চাঁদরাই ও সমেত্মাষ রায় দস্যু প্রকৃতিসম্পন্ন ছিলাম। তাঁদের ঔদ্ধত্য এসনই ছিল যে তাঁরা পাঠান মোগল যুদ্ধের ডামাডোলের মধ্যে বাদশাহর খাজনা দেওয়াও বদ্ধ করে দিয়েছিলাম। এই চাঁদ রায় একটি নির্দোষ ব্রাক্ষ্মণ বালককে হত্যা করে বায়ু রোগগ্রস্থ হয়ে পড়েন এবং তাঁর অবস্থা শাষ্কটাপন্ন হয়ে পড়ে। দৈবনালা শ্রবণে শেষপর্যমত্ম খেতুরীর সন্ন্যাসী রাজকুমারের (নরোত্তমের) শরণাপন্ন হয়ে আরোগ্য লাভ করেন। পরে তিনি এবং তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গো অনেক ব্রাক্ষণ সমত্মান নরোত্তমের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। নরোত্তম সমাজের নিকট আকৃষ্ট হয়ে বৈষ্ণবেরা এক বিশাল সমাবেশে নরোত্তমকে খাঁটি ব্রাক্ষণ বলে ঘোষণা দিয়েছিলাম। এই অবস্থায় ব্রাক্ষণ সমাজের ক্রোধ সকল সীমা অতিক্রম করে নরোত্তমকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার ফন্দি আঁটতে লাগলে। পক্কপল্লীর রাজা নৃসিংহ রায় একজন গোঁড়া ব্রাক্ষণ ভক্ত হিন্দু। ব্রাক্ষণসমাজের প্রতিনিধিগণ এই রাজার শরণাপন্ন হয়ে সাহায্যপ্রার্থী হলেন। যাতে নরোত্তমকে ব্রাক্ষণ শিষ্য গ্রহণ করা থেকে বিরত রাখা যায়। তাঁরা সেরা ব্রাক্ষণ শাস্ত্রজ্ঞপন্ডিত পাঠিয়ে নরোত্তমকে তর্কযুদ্ধে হারিয়ে হেয় প্রতিপন্ন করারও ফন্দি আঁটলেন। কিমত্মু শেষ পর্যমত্ম নরোত্তম শিষ্য গঙ্গানারায়ণ চক্রবর্তী এবং সহৃদ রামচন্দ্র কবিরাজ ও তাঁর সহোদর কবি চূড়ামণি গোবিন্দ দাসের বুদ্ধি চাতুর্যে প্রতিপক্ষের সকল চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। শেষ পর্যমত্ম রাজা নৃসিংহরায় সপার্ষদ পন্ডিতমন্ডলীসহ নরোত্তমের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে গৌরবান্বিত হন। নরোত্তমের সাহিত্যকর্মও মধ্যযুগের পদাবলী সাহিত্যের ইতিহাসে অতুলনীয় সম্পদ। বৈষ্ণব পদাবলী বৈষ্ণব শাস্ত্রেরই রসভাষ্য। প্রধানত রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলার বিচিত্র পর্যায় বর্ণনাই এর উদ্দেশ্য; নর-নারীর পার্থিব প্রেমের সকাল ভাবানুভবের মধ্যদিয়ে পারমার্থিক প্রেমতত্ত্বের এক অতুলনীয় মহিমা পদাবলী সাহিত্যে বিধত। পর্ববাগ অনুরাগ অভিসার মান. মান. মিলন. বিরহ. প্রার্থনা, আত্মনিবেদন প্রভৃতি ধারাক্রমের মধ্য দিয়ে রাধাকৃষ্ণ প্রেম বৈষ্ণব পদাবলীতে এমন এব তত্ত্বে উপনীত হয়েছে, যেখানে অক্তের সঙ্গে ভগবানের জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার, সীমার সঙ্গে অসীমের এক মহামিলনের, এক অপার্থির পূর্ণতার অভিপ্রায়ই ব্যক্ত হয়েছে। এজন্য পদাবলী সাহিত্যের আবেদন শুরু ভক্ত বেষ্ণব সমাজের মধ্যেই সীমিত থাকেনি, তা দেশকাল থাকেনি, তা দেশকাল নির্বিশেষে সকল মানুষের  আত্মিক আকুতিকেই অভিব্যক্ত করেছে। মধ্যযুগের অপরাপর প্রায় কয়েকশত পদকারদের পদচারণায় মুখরিত পদাবলী সাহিত্যের বিশাল ভুবনে, বিদ্যাপিত-চন্ডীদাস- জ্ঞানদাস-গোবিন্দ দাস বলরাম দাস প্রমুখ বিখ্যাত পদকারদের সাথে নরোত্তম দাস ঠাকুরও অমরত্ব লাভ করেছেন। তাঁর কীর্তিরাজি পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, তিনি মূলত সাধন মার্গের রাগাত্মিক পদ্ধতির পথিক ছিলেন। অর্থাৎ রাধাভাবে নয়, সখীভাবে রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলার অপার্থিব মাধুর্যের মধ্য ব্যক্ত করেছেন। তিনি একাধারে বৈষ্ণক শাস্ত্র বিষয়ক বহুগ্রন্থ যেমন রচনা করেছিলাম, তেমনি অনেক উৎকৃস্ট পদও রচনা করেছিলেন। তথ্য সূত্র: রাজশাহীর প্রতিভা ও নরোত্তম দাসের সংক্ষিপ্ত জীবনী নামের বই থেকে।